হাত কার পুড়ে যায়! কে হারায় চোখ!..কাবেরী গায়েন

১০ বছরের শিশু মুরাদের দুই হাত ঝলসে গেছে। পান্থপথে গত শুক্রবার সে কুড়িয়ে পেয়েছিল যে ককটেল, সেই ককটেলের বিস্ফোরণেই ঝলসে গেছে তার দুই হাত। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ঝলসে যাওয়া দুই হাত নিয়ে মুরাদ চিকিৎসা নিচ্ছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসনকেন্দ্রে। মুরাদের বাবা সিএনজিচালক জামাল হোসেনের বরাতে জানা যায়, পান্থপথের মোড়ে এক গাছের নিচে লাল টেপ মোড়ানো ককটেলকে মুরাদ বল মনে করে হাতে নিলে সেটি বিস্ফোরিত হয়, ঝলসে যায় তার হাত।
এর আগে হরতাল চলাকালে পশ্চিম জুরাইনে নয় বছরের রহিমা আক্তার তাদের বাসার সামনে বালুর মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছিল লাল টেপ মোড়ানো একটি ককটেল। অমলিন শিশু কুড়িয়ে পাওয়া ককটেলকেই মনে করেছিল বল। হাতে তুলে নেওয়া সে বলরূপী ককটেলের বিস্ফোরণে তার ডান চোখ জখম হয়েছে গুরুতরভাবে। তার চোখে অস্ত্রোপচার হয়েছে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। রহিমার দুই চোখই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে ডান চোখে দেখতে না পাওয়ার আশঙ্কা জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। মনে পড়ছে কবীর সুমনের সেই বিখ্যাত গান: ‘বাহবা শাবাশ! এই তো চাই! ছোটরা খেলছে, আসুন, আমরা বোমা বানাই।’
শুধু ছোটরা ভুল করে ককটেলকে বল ভেবে হাতে তুলে নিলেই যে কেবল ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে, এমন নয়। স্রেফ বসে থাকলেও কেউ ছুড়ে দিতে পারে ককটেল, গলে যেতে পারে চোখ। হরতাল সমর্থনকারীদের ছোড়া ককটেলে যেমন বাঁ চোখ গলে গেছে পঞ্চাশোর্ধ্ব দিনমজুর আবদুর রহমানের। আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আবদুর রহমানের কাহিনি বড় মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করেছেন কমল জোহা খান (প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর, ২০১৩)। দিনমজুরি ভিত্তিতে রংমিস্ত্রির কাজ করেন আবদুর রহমান। বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনায়। সেখানেই থাকে স্ত্রী-সন্তান। পাঁচ দিন কোনো কাজ পাননি তিনি, তাই হরতালের দ্বিতীয় দিনে কাজ পাওয়ার জন্য ছিলেন মরিয়া। সঙ্গীদের সঙ্গে কাজ পাওয়ার আশায় বসেছিলেন এক চায়ের দোকানে। হরতালকারীদের ছুড়ে দেওয়া ককটেল বিস্ফোরণে তাঁর চোখ বেয়ে রক্ত পড়তে থাকে। চিকিৎসকেরা জানান, এক চোখ গলে গেছে। চিকিৎসার জন্য সাত হাজার টাকা প্রয়োজন। তাঁর ভাই, যিনি নিজেও রংমিস্ত্রি, ছুটে এসেছেন বটে ভাইয়ের খবর শুনে, কিন্তু তাঁরও বড় অভাব, এক বেলা কামাই না করলে খাবার জুটবে না। বিমর্ষ প্রশ্ন তাঁর, এই সাত হাজার টাকা তাঁরা কোথায় পাবেন? চোখের ভেতর থেকে একটি স্প্লিন্টার বের করলেও সেই চোখে আর দেখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। প্রতিবেদনটির শিরোনাম, ‘আমার মাথায় বাড়ি দিল কে?’। প্রশ্নটি যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা আবদুর রহমানের। আমি ভাবী, প্রশ্নটি আমাদের সবার নয় কেন?
দুই. টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে মারা গেছে ১৪ জন। মানুষ মরবে, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হবে, বাস-ট্রেনে আগুন দেওয়া হবে, পুলিশের ওপর ঝটিকা আক্রমণ হবে—এ বিষয়গুলো নৈমিত্তিক হয়ে গেছে যেন-বা। তবে কিছু কিছু জরুরি বিষয়কে হরতালের আওতামুক্ত রাখার রেওয়াজ ছিল, কিছুদিন আগেও ছিল। এবারের হরতালে হামলা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রেও। অ্যাম্বুলেন্স, সাংবাদিক ও সংবাদ বহনকারী গাড়িও হয়েছে হামলার শিকার। রেহাই পায়নি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সও। হরতালের প্রথম দিনেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ফেনীর পথে নিয়ে যাওয়া লাশ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সে হামলা হয়েছে। পটিয়ায় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করেছে হরতাল সমর্থনকারীরা। একই দিনে বগুড়ার নানা জায়গায় অন্তত ১৫টি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন উঠছে, হরতালকারীরা কি তবে এবার অ্যাম্বুলেন্স বা সংবাদমাধ্যমকে হরতালের আওতামুক্ত রাখেনি? অথচ সাদা-কালো যুগের প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র দেখে দেখে শিখেছি, এসব জরুরি সেবা প্রদানকারী বিষয়গুলো সারা পৃথিবীতেই এমনকি যুদ্ধের আওতামুক্ত থাকে। হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন সাংবাদিকেরা। নাটোরে আহত আরটিভির চিত্রগ্রাহক শেখ তোফাজ্জেল হোসেনের ঘটনাটি স্তব্ধ করে দেয়। ককটেল হামলায় আহত হওয়ার পরও কয়েকজন যুবক তাঁকে লাঠিপেটা করেছেন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
তিন. আর শঙ্কায় আছে বাংলাদেশের মানুষ। শঙ্কায় আছে কারণ, ৪ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। কিন্তু হরতালের কারণে তা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। হরতাল চললে ফের উড়ে যাবে কার চোখ? ঝলসে যাবে কার হাত? এমন আশঙ্কায় আছে সারা দেশের মানুষ। তাদের শঙ্কা, ফের হরতাল হলে খাবে কী? ফিরছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিকশায় শুক্রবার ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শেষে। রিকশাওয়ালার মুখ-চোখ শুকিয়ে গেল ফের হরতালের খবর আরেক রিকশাওয়ালা খিস্তিসহযোগে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমার রিকশাওয়ালা বেশ বয়স্ক, ভদ্র। মৃদু গলায় বললেন, ‘আর বাঁচবার পাইরলাম না।’
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা টেলিফোন সংলাপে পরস্পরকে দোষারোপ করেছেন হরতাল দিবস নিয়ে। শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, ১৯৯৬-২০০১ সালের মধ্যে বিরোধী দল ৩৩০ দিন হরতাল করেছে, খালেদা জিয়া দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ করেছে তাদের সময়ে ১৭৩ দিন। কী ছিল এসব হরতালের এজেন্ডা? আমাদের দেশে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা হিসেবে আর হরতাল আসে না, আসে রাজনৈতিক রুটিন হিসেবে, যেন-বা জনসম্পৃক্ত কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে। রানা প্লাজায় ধস কিংবা আদমজী বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে কোনো কার্যকর হরতাল বড় দলের কোনো বিরোধী দলই দেয়নি। তবে সহিংসতা যে শুধু হরতালকেন্দ্রিক এমন নয়; বরং আমি বলব, এক বড় অংশজুড়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক।
চার. নির্বাচন সামনে রেখে এই যে হরতাল-সহিংসতার শঙ্কা, তার আরেকটি মাত্রার কথা না বললেই নয়। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বাড়তি শঙ্কা। এই প্রবন্ধটি লেখার সময়, যখন দীপাবলি উৎসব উদ্যাপন করছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়, ঠিক তখন গত বছর রামুতে বৌদ্ধদের ওপর সংঘটিত হামলার মতোই ফেসবুকে মহানবী (সা.)কে কটূক্তি করার অভিযোগ তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মতিউর রহমান নিজামীর নির্বাচনী এলাকা পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় হিন্দুদের বেশ কিছু বাড়ি ও দোকান। ভাঙচুর করা হয়েছে দুটি স্থানীয় কালীমন্দির। অথচ কথিত অপরাধী দশম শ্রেণীর ছাত্র রাজীব সাহা আদৌ ফেসবুক ব্যবহার করে কি না, সে কথা তার বন্ধু-প্রতিবেশী-সহপাঠী কেউই নিশ্চিত করতে পারেনি। দেশের
নানা জায়গা থেকে ইতিমধ্যে হিন্দুদের বাড়িঘর লুট ও চাঁদাবাজির খবর পাওয়া যাচ্ছে। শুক্রবার আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন তিনজন আত্মীয়, পরিচিত নারী-পুরুষ। তাঁদের শঙ্কা বড় প্রবল। বললেন, ‘এমন চলতি থাকলি ইলেকশানের সোমায় নোমোগো (হিন্দু) যে কী হবেনে!’
কী হবে রহিমা আক্তার, মুরাদ আর আবদুর রহিমের? সামনের টানা ৬০ ঘণ্টার হরতালে কে হারাবে চোখ ফের? কী হবে নিজামীর নির্বাচনী এলাকা সাঁথিয়ার মতো আরও নানা অঞ্চলে, যেখানে ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভোট ভূমিকা রাখে ভোটের ফলাফলে? নির্বাচনকেন্দ্রিক হরতাল-সহিংসতায় কারা মারা যায়, কারা হারায় চোখ, ঝলসে যায় কার কচি হাত?
‘চোখ ভিজে আসে, চোখ ভেসে যায়।’
ড. কাবেরী গায়েন: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।