সোনালী ও জনতা ব্যাংক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক

উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে সোনালী ও জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি। ব্যাংক দুটির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণও ভেঙে পড়েছে। সরকারি বলেই টিকে আছে এই দুটি ব্যাংক।অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পরিস্থিতিও ভালো নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মনীতি মেনে চার রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে। এর আনুষ্ঠানিক নাম ‘স্পেশাল ডায়াগনস্টিক রিভিউ এক্সামিনেশন’। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সোনালী ও জনতার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বা অ্যালার্মিং। আর অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পরিস্থিতি কনসিডারেবল বা বিবেচনাযোগ্য।বিধান হচ্ছে, ফলাফল উদ্বেগজনক হলে সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে। আর বিবেচনাযোগ্য পর্যায়ে হলে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।সরকারি ব্যাংক বলেই সেই পথে যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বরং কোনো মৌলিক পুনর্গঠন প্রস্তাব না করে নতুন করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মূলধন জোগাতে সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। এমনকি রাষ্ট্র খাতে একসময়ের গর্ব করার মতো বেসিক ব্যাংকও তাদের মূলধন পুনর্ভরণে সরকারের কাছে ৩৫০ কোটি টাকা চেয়েছে।হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, মাদারটেক, মাদার স্পিনিংসহ বড় বড় সব ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থাকে অত্যন্ত নাজুক করেছে। আর ব্যাংক পরিচালনায় অদক্ষতা ও পরিচালনা পর্ষদের রাজনীতিকরণের কারণে এই পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। শেষ সময়ে পরিচালনা পর্ষদ কিছুটা পুনর্গঠন করেছে সরকার। কিন্তু আগের পর্ষদের কারণে ব্যাংকের যে নাজুক পরিস্থিতি, তা কাটিয়ে উঠতে পারছে না ব্যাংকগুলো।চার ব্যাংকেরই ঋণ আদায় পরিস্থিতিও খুবই নগণ্য। অথচ ব্যাংকগুলো নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তা বড় করে দেখাচ্ছে। আবার নিয়মনীতি মেনে ঋণ যথাযথ শ্রেণীকরণও করা হয় না। পুনঃ তফসিল করতে নেওয়া হয় না নগদ এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট)। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আর্থিক পরিস্থিতি পরীক্ষায় আরও দেখা গেছে, সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার শাখা ও সরকারের আমানতের সিংহভাগ এই ব্যাংকগুলোতে থাকে। এতে নগদ অর্থপ্রবাহ বজায় থাকছে। তবে এই বিপুল অর্থের ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত নাজুক।

ব্যবস্থাপনাতেও আছে পদ্ধতিগত বিভিন্ন ত্রুটি, যা জালিয়াতির সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এই অর্থ নিয়ে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে। চার ব্যাংকের এই চুলচেরা আর্থিক বিশ্লেষণ ২০১২ সালভিত্তিক।

এর পরও অবস্থা ভালো হয়নি। ২০১৩ সালের জুন শেষের চিত্র অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। জুনভিত্তিক আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি ‘ক্যামেলস রেটিং’ (মূলধন, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, আয় ও তারল্য পরিস্থিতি বা ক্যামেল)-এ চার ব্যাংকেরই সম্পদ বা ঋণের গুণগত মান অসন্তোষজনক বলা হয়েছে। সার্বিক রেটিং দাঁড়িয়েছে সোনালীর পরিস্থিতি অসন্তোষজনক, আর বাকি তিন ব্যাংক প্রান্তিক পর্যায়ে।

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্র খাতের বিশেষত সোনালী ও জনতা ব্যাংকে যেভাবে ঋণ আটকে পড়ছে, তাতে আপাতত মূলধন পুনর্ভরণ দিয়ে ঠেকানো যাবে ঠিকই। তবে টাকা শেষ হয়ে যাবে। নতুন করে আবারও মূলধনের দরকার হবে।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, সাধারণ মানুষের করের টাকা ব্যাংকগুলোতে দেওয়ার আগে প্রয়োজন এর পুনর্গঠন। এ পর্যায়ে ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনাতে পরিবর্তন আনা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক বসিয়ে কিংবা পরামর্শক নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকগুলো পরিচালনা করতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এই ব্যাংকগুলোর একটা সমঝোতা চুক্তি আছে। এতে শর্ত হচ্ছে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনবে। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো। প্রতিটি প্রান্তিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। গত বছরের জুন শেষে যা ছিল, সেপ্টেম্বর শেষে তা হয়েছে আরও বেশি। সেপ্টেম্বর থেকে আরেক লাফ দিয়ে বেড়েছিল ডিসেম্বর মাসে। একইভাবে বাড়ে ২০১৩ সালের মার্চ প্রান্তিকে। তবে গত জুনে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে।

বেসিক ব্যাংকেও ব্যাপক জালিয়াতি, লুটপাট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত যোগসাজশ ও জাল-জালিয়াতি থেকে ‘দায়মুক্তি’ দিতে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দিয়ে একটি স্মারকে স্বাক্ষর করিয়েছে গত ১৬ জুলাই। এখন এই ব্যাংকটিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভীর পর্যবেক্ষণে এসেছে।

সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্মারকে স্বাক্ষর করিয়ে নিচ্ছে ১০ বছর ধরে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এর পর্যালোচনাও করা হয়। কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করার পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আবারও আগের মতোই অবস্থা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের শুরুতেও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নতুন সমঝোতা চুক্তি হয়েছে।

খেলাপি ঋণ: সব মিলে জুন শেষে চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হয়েছে ২৩ হাজার ৮৫২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বা ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ। মার্চ শেষে ছিল ২৪ হাজার ৪০৩ কোটি ১২ লাখ টাকা বা ২৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। এই অর্থ দিয়ে অনায়াসে একটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।

মার্চ পর্যন্ত হিসাবে এই চার ব্যাংক ১০ হাজার ৬৫২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন বা রাইট-অফ করেছে। সুতরাং, প্রকৃতপক্ষে চার ব্যাংকের মার্চ ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ ৩৫ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। এই অর্থের বড় অংশই আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর এই অর্থ যোগ করলে পদ্মা সেতুর সঙ্গে একাধিক ঢাকা-চট্টগ্রাম ‘ফোর লেন’ মহাসড়ক নির্মাণ করাও সম্ভব।

জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছিল রূপালী ব্যাংকে। এই ব্যাংকটিতে তিন মাসে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছিল দুই হাজার ৬৭ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৯২৮ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল পাঁচ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা বা ২৮ দশমিক ১৭ ভাগ। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৭৬১ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছিল চার হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা বা ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

তবে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ৩০০ কোটি টাকা কমে হয়েছিল ১১ হাজার ৭৪৭ টাকা বা ৩৪ দশমিক ৪৯ ভাগ। কিন্তু এপ্রিল-জুন সময়ে আবারও তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১২ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ০২ শতাংশ।

আদায় ও লোকসানি শাখা: ২০১৩ সালের প্রথম তিন মাসে সোনালী ব্যাংক হল-মার্কের রপ্তানি হওয়া পণ্যের প্রত্যাবাসনের অর্থ পেয়েছে। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে সোনালী ব্যাংকের নগদ আদায় হয়েছে ৮৭২ কোটি টাকা। জনতা আদায় করেছে ৩৪৬ কোটি টাকা, অগ্রণী ১১৫ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংক মাত্র নয় কোটি টাকা।

মার্চভিত্তিক বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চার ব্যাংকে লোকসানি শাখাও বেড়ে হয়েছে ২৪৯টি। অথচ ২০১২ সাল শেষে লোকসানি শাখা ছিল ১৮২টি। এর মধ্যে ২০১২ শেষে জনতা ব্যাংকে লোকসানি শাখা ছিল ৮২টি, যা হয়েছে ১০৭টি। অগ্রণী ব্যাংকে ৩৪ থেকে বেড়ে ৫৮টি ও রূপালী ব্যাংকে ১২ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২টি। তবে সোনালী ব্যাংকে লোকসানি শাখা ৫৪ থেকে দুটি কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পরিস্থিতিকে খুবই খারাপ বলে মনে করছে।

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারকাত গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে গত ১৮ আগস্ট ছয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে এ প্রসঙ্গ এসেছিল। এই ডায়াগনস্টিক রিভিউ এক্সামিনেশনের প্রতিবেদন কাউকে দেওয়া হয়নি। এটা হাতে পেলে তিনি মতামত দিতে পারতেন। তিনি আরও বলেন, একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় পরিস্থিতি হচ্ছে ব্যাংকের প্রধান মানদণ্ড। জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১৬ ভাগ। গত তিন মাসে আদায়ও ভালো হয়েছে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, হল-মার্ক ও বেক্সিমকোসহ বেশ কিছু বড় কোম্পানির খেলাপি ঋণ বাড়ায় পরিস্থিতি খানিকটা খারাপ হয়েছে। এ জন্য সরকারের কাছে তিন হাজার ২৭৫ কোটি টাকার মূলধন চাওয়া হয়েছে। তবে গত জুলাই মাসে ব্যাংক দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা আদায় করেছে, এর মধ্যে এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা নগদ। ২০১২ সালেও ব্যাংক অর্থ ধার নিয়ে চলেছে, এখন অর্থ উদ্বৃত্ত রয়েছে।

চার ব্যাংকের অবনতি: ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে কোম্পানি করা হয়। তার আগে ২০০৪ সালে নেওয়া বিশ্বব্যাংকের শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও ব্যাংক আধুনিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় ব্যাংকগুলোতে তিন বছরের জন্য ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের উন্নতিতে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় কোম্পানি গঠন করা হয়। আর রূপালী ব্যাংক আগে থেকেই কোম্পানি ছিল।

কোম্পানি গঠনের পর বিধিগতভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর সরকারের সরাসরি কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। নিয়ম হচ্ছে, বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) মালিকানা যেহেতু সরকারের সেই বিবেচনাতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পরিচালক নিয়োগ দেবে সরকার। পরে এই পরিচালকেরাই একজনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করবেন। অথচ সরকার রাজনৈতিক বিবেচনাতে ব্যাংকগুলোতে চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগের কাজটি সরাসরি করছে।

একইভাবে শীর্ষ নির্বাহী ও তার পরের দুই ধাপ কর্মকর্তাও সরকার নিয়োগ দিচ্ছে। এতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন সংস্থায় পরিণত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি থাকলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। ব্যাংকগুলো সমঝোতা চুক্তির শর্ত পূরণকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না। এতে পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে বলে ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে।