সমঝোতা নয়, সংঘাতের দৃশ্যপট…এ এম এম শওকত আলী

বিগত দুই সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহে জনমনে কিছু আশার উদ্রেক হয়েছিল। সংলাপ দুই প্রধান দলের মধ্যে হবে। প্রথমে দুই দলের মহাসচিবদ্বয় টেলিফোনে আলাপ করেন। ওই সময় সরকারের এক মন্ত্রী একটি তথ্য প্রচার করেন। এতে বলা হয়, ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধান বিরোধীদলীয় নেতাকে সংলাপের বিষয়ে টেলিফোন করবেন। এ টেলিফোনের আগে প্রধান বিরোধী দলের নেতা এক সমাবেশে দলকে সংলাপে বসার আমন্ত্রণ না জানালে ৬০ ঘণ্টার হরতাল দেওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছিলেন। এ সমাবেশের অনুমতি প্রদানের বিষয়েও যথেষ্ট নাটকীয়তার দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নিজস্ব প্রধান কার্যালয়ের প্রধান বিরোধী দল সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছিল। সে অনুমতি দেওয়া হয়নি। প্রধান বিরোধী দল এ পরিপ্রক্ষিতে ঘোষণা করে যে অনুমতি ছাড়াই নির্বাচিত স্থানে সমাবেশ করা হবে। এরপর মহানগর পুলিশ কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। প্রাথমিকভাবে বিরোধী দল কিছুটা নারাজ হলেও শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। সমাবেশে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সংলাপের আমন্ত্রণ না পেলে ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা আসে। এর কিছু পরেই দুই নেতার টেলিফোনে আলাপের জন্য সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছিল। বাদ সাধে লাল টেলিফোন। প্রধান বিরোধী দলের নেতার লাল টেলিফোন বিকল ছিল। অতীতে সিদ্ধান্ত ছিল যে মন্ত্রী, সচিবসহ সবার লাল টেলিফোন সচল রয়েছে কি না তা তখনকার বিটিটিবির এক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রতিদিন সকালে পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। শেষ পর্যন্ত টেলিফোনে কথা হয়, কিন্তু উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধান হয় না। নৈশ ভোজে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণের পূর্বশর্ত ছিল হরতাল প্রত্যাহার করতে হবে। এ শর্ত প্রধান বিরোধী দলের নেতা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে ৬০ ঘণ্টার অবিরাম হরতালের সূচনা হয়। এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের হরতালের সহিংসতায় প্রায় ১৯ জনের প্রাণহানি হয়।

ক্ষমতাসীন দলের প্রধান হরতাল প্রত্যাহারের যে পূর্বশর্ত আরোপ করেছিলেন, তা প্রত্যাখ্যান করার যুক্তি ছিল সময়ের স্বল্পতা। প্রধান বিরোধী দল দাবি করে যে প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই; কারণ এ বিষয়ে ১৮ দলীয় জোটের অন্যান্য শরিক দলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। এ দলের পাল্টা প্রস্তাব ছিল, ২৯ তারিখ ৬টার পর যেকোনো সময়ে ও স্থানে আমন্ত্রণ সাপেক্ষে তারা সংলাপের জন্য প্রস্তুত। এ প্রস্তাব ক্ষমতাসীন দল বা জোট মেনে নেয়নি। এর কারণও ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা ব্যাখ্যা করেছেন। হরতাল শেষ হওয়ার পর সংলাপে বসলে তা হবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পরাজয়। অর্থাৎ বিরোধী দলের চাপের মুখে তারা সংলাপে পুনরায় রাজি হয়েছে। রাজনৈতিক পরাজয়ের কোনো ব্যাখ্যা জনগণ জানে না। সাধারণ অর্থে জনগণ যা মনে করে তা হলো, রাজনৈতিক পরাজয়ের অর্থ নির্বাচনে পরাজয় অথবা সংসদীয় ভোটে পরাজয়। নির্বাচনে কোনো দল পরাজিত হলে ধরে নেওয়া হয় যে ওই দলকে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিতে আগ্রহী নয়। রাজনৈতিক পরাজয়ের অন্য দুটি বিষয়ও দৃশ্যমান ছিল। এক, প্রধান বিরোধী দলের সমাবেশের বিপরীতে ক্ষমতাসীন দলও পাল্টা সমাবেশের ঘোষণা দেয়। এ ধরনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক মানসিকতা যুক্ত। এ জন্য অতীতে এবং এখনো শোনা যায় যে এক দল অন্য দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা বা প্রতিহত করবে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল কোনো সমাবেশ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে নিজ কার্যালয়ের সামনে তারা একত্র হয়। ঘোষণা দেওয়া হয় যে সমাবেশ না করলেও তারা রাজপথ ছাড়বে না। এ ধরনের মানসিকতাও রাজনৈতিক পরাজয়ের ভাবনাপ্রসূত। এর ফলে রাজপথে সংঘাত ও সহিংসতার পথ প্রশস্ত হয়।

দুই প্রধান দলের নেতাদের টেলিফোনে সংলাপের সূচনা বন্ধ হয় শর্তযুক্ত বিষয়বস্তু। প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলের প্রধানকে বলেন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি নীতিগতভাবে মেনে সংলাপ করতে হবে। পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন দলের পাল্টা প্রস্তাব ছিল সর্বদলীয় সরকারই হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ থেকে বোঝা যায়, প্রধান বিরোধী দল স্বীয় অবস্থানে অনড় থাকে। এ ছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কোনো ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান বিরোধী দল মানতে রাজি নয়। একজন প্রখ্যাত আইনজীবী এর আলোকে অন্য একটি প্রস্তাবের সূচনা করেন। দুই দল থেকে কোনো সরকারপ্রধান হবে না। তবে দুই দলসহ অন্য একটি দলের প্রতিনিধি সরকারে থাকতে পারে। প্রধান দুই দলের প্রতিনিধি সমান হবে। এক দলের পাঁচজন ও অন্য দলের পাঁচজন। ভিন্ন একটি দল থেকে একজন প্রতিনিধি থাকতে পারেন। এ প্রস্তাব সম্পর্কে প্রধান দুই দলের কোনো মতামত সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া যায়নি। সরকারপ্রধান হবেন সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য এক ব্যক্তি। এ প্রস্তাবে দেখা যায়, এতে প্রধান দুই দলের কিছু স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রধান দুই দলের সমঝোতার সদিচ্ছা থাকলে এটি একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হওয়া সম্ভব ছিল। অন্যদিকে এ যুক্তিও দেওয়া যায় যে ক্ষমতাসীন দলের সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেওয়ার অর্থ তারা পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও ছাড় দিয়েছে। তাদের পূর্ববর্তী অবস্থান ছিল অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের প্রথা অনুযায়ী ক্ষমতাসীন দলই হবে নির্বাচনকালীন সরকার।

ওই প্রথা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সময়ে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দল তথা নির্বাচনকালীন সরকার কোনো নীতির পরিবর্তন করবে না। অর্থাৎ নিত্তনৈমিত্তিক বা রুটিন কাজ করবে। এ বিষয়টিও ক্ষমতাসীন দল থেকে বারবার প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু বিরোধী দল তা মেনে নেয়নি। অর্থাৎ দুই দলের মধ্যে আস্থার প্রচণ্ড অভাব। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব দর্শন ও মতবাদ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং সারা বিশ্বে এটাই বাস্তবতা এবং এ জন্যই বলা হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। দর্শন ও মতপার্থক্য থাকার জন্যই রাজনৈতিক বিতর্ক হয়। অন্যান্য দেশে এ বিতর্ক হয় সংসদের অভ্যন্তরে। কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্য সমাবেশও হয়, যা শান্তিপূর্ণ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিতর্ক সংসদের তুলনায় রাজপথেই বেশি হয়েছে। এ বিষয়টি এখনো দৃশ্যমান। সর্বদলীয় সরকার গঠনের বিষয়টি গত মঙ্গলবারের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেছেন। এ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ সিপিবি ও বাসদের সঙ্গে আলোচনায়ও তিনি বসেছেন। তারপর ওই দল প্রধান বিরোধী নেতার সঙ্গে আলোচনায় বসেছে। এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি মুখ্য, তা হলো ১৮ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো বাদে অন্য সব নিবন্ধিত দল। জামায়াতও এখন পর্যন্ত একটি নিবন্ধিত দল। তবে তাদের ১৮ দলীয় জোটভুক্ত হওয়া ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্তির দাবি করার জন্য কোনো আমন্ত্রণ জানানো হবে না। এ বিষয়টি এরই মধ্যে স্পষ্ট। কারণ প্রধান বিরোধী দলকেই সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ বিষয়ে যেটি প্রাসঙ্গিক, তা হলো সর্বদলীয় সরকারে অন্য দলের কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত হবে কি না; সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিসভার অবয়ব কত হবে- এ বিষয়গুলো এখনো অস্পষ্ট। স্বাভাবিক নিয়মে সর্বদলীয় সরকারে কিছু অনির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ সব নিবন্ধিত দলই বর্তমান সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে সক্ষম হয়নি। যদি তাই হয়, তাহলে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক হবে কি না।

এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সংবিধানে মন্ত্রিসভায় এক-তৃতীয়াংশ অনির্বাচিত ব্যক্তির সংস্থান সম্পর্কে অতীতে নজির রয়েছে। সাধারণ অর্থে এ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের টেকনিক্যাল মন্ত্রী আখ্যা দেওয়া হয়। সার্বিকভাবে বলা যায়, অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয় এখনো অস্পষ্ট। এ নিয়ে কিছু বিতর্কও হচ্ছে। অবসরপ্রাপ্ত কিছু মন্ত্রিপরিষদসচিবের মতে, ক্ষমতাসীন সরকার পূর্বঘোষিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে সামান্য রূপরেখা দিয়েছে, তা মানা হচ্ছে না। এক, মন্ত্রিসভা এখনো নীতিবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এবং এ বিষয়ে আইন সংসদেও অনুমোদিত হবে। এর মধ্যে আরপিওর কিছু সংশোধনী হয়েছে, যার জন্য নির্বাচন কমিশনের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। মন্ত্রিসভায় সাম্প্রতিককালে যে সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে, সেটি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য ন্যূনতম তিন বছর রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত করা হয়েছে। অনেকের মতে, এর ফলে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা শুধু টাকার জোরে কোনো কোনো দলের প্রার্থী হিসেবে সংসদে আসন লাভ করবেন। অতীতে যে এ ধরনের ব্যক্তি সংসদে ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু ২০০৯ সালের আরপিওতে তিন বছর সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতা ওই সময় সুশীলসমাজসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার পর নির্বাচন কমিশন এ বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। গণমাধ্যমে এ ধারার বিলুপ্তির সপক্ষে কোনো যুক্তি পাওয়া যায়নি।

সমঝোতা ও সংঘাতের বিতর্ক এখনো চলছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। নির্বাচন কমিশনও প্রার্থীদের আচরণবিধি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অন্যদিকে ১৮ দলীয় জোট ভবিষ্যতের কিছু কর্মসূচির রূপরেখাও দিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম ১৫ নভেম্বর রাজধানীতে সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে। এতদিন তারা অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় ছিল। এখন তারা প্রকাশ্যে কথা বলছে। সব মিলিয়ে দেশ যে এখন মহাসংকটে, সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই। তবু কি সমঝোতা হবে না? রাজনীতি কেন সংকট বা অশান্তির কারণ হবে- এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা