সমঝোতা ছাড়া তফসিল নয়…ডক্টর তুহিন মালিক

গত এক মাসে জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে দুটি শব্দ- সংলাপ ও সংবিধান। সমঝোতা শব্দটিও একই সঙ্গে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে সংঘাতের দিকে। সরকার সংলাপ থেকে লাফ দিয়ে চড়ে বসল একদলীয় নির্বাচনের চিকন মগডালে। এদিকে নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি আছে। অথচ এখনো নির্বাচন কমিশন গতানুগতিক বুলি আওড়াচ্ছে। আচরণবিধির খসড়া নাকি তারা প্রস্তুত করে ফেলেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই আরপিও সংশোধন করা হলো মহান সংসদে। এখন থেকে যে কেউ চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো দলের প্রার্থী হতে পারবেন এ সংশোধনীর ফলে। টাকা যার মনোনয়ন তার- নিশ্চিতভাবে আগামী নির্বাচনের এটাই হবে বড় নীতি। ‘দিনবদলের’ সরকার এখন ‘দলবদলের’ সরকারে পরিণত হলো।

সমস্যা আরো আছে। সংশোধিত সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে, এমন মৌলিক কিছু বিষয়ের সুরাহা এখন পর্যন্ত করা হয়নি। যেমন বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী কেউ রাষ্ট্রের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীদের লাভজনক পদের বাইরে রাখা হলেও সংসদ সদস্যদের বাইরে রাখা হয়নি। কাজেই সদস্যপদ বহাল থাকলে বর্তমান এমপিরা নির্বাচন করতে পারবেন না। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ ও সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের মামলাগুলোও ঝুলে রয়েছে আইনি বাহাসে।

সংসদের মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদটি সংযোজিত করা হয়। তাতে মোটা দাগে শেষ ৯০ দিনকে পাঁচ বছরের হিসাব থেকে কেটে সংসদের মেয়াদকে ৯০ দিনের মতো কমিয়ে ছোট করা হয়। এই ৯০ দিন কমানোকে সংবিধানের নবসংযোজিত ৭২(১) অনুচ্ছেদে সিলমোহর মেরে পাকাপোক্ত করে দেওয়া হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীতেই। যাতে পরিষ্কারভাবেই নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়ের মধ্যে সংসদের এক অধিবেশনের সমাপ্তি ও পরবর্তী অধিবেশনের প্রথম বৈঠক পর্যন্ত ৬০ দিনের বিরতির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাকে রহিত করে ৯০ দিনের বিরতি দেওয়া হয়েছে। সোজা কথায় এই দুই অনুচ্ছেদের মানে দাঁড়ায়, এই ৯০ দিনে সংসদের কোনো অধিবেশন বসতে পারবে না। যদি অধিবেশন বসাটা বৈধ ঘোষণা করা হতো তবে কেন ৭২(১) অনুচ্ছেদটি সংযোজন করা হলো? কারণ এ বিধান দুটি সংযোজন করে নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের সময়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি, তফসিল, নির্বাচন পরিচালনা ও সম্পন্নকরণের লক্ষ্যে সবার জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য সাংবিধানিক নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।

এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন সময় বলতে ৯০ দিনের হিসাবটি সংবিধান, আরপিও ও আচরণবিধিতে স্পষ্টভাবেই বর্ণিত আছে। কিন্তু এই ৯০ দিনেও সংসদ তার অধিবেশন চালিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই নির্বাচন কমিশন নড়েচড়ে বসে। তাড়াহুড়া করে সংসদের অবৈধ অধিবেশনকে জায়েজ করতে পুরো নির্বাচনকালীন সময়কেই তারা পাল্টে ফেলে। ঘোষণা দেয়, আজ থেকে নির্বাচনকালীন সময় হবে ৯০ দিনের পরিবর্তে ৪৫ দিন। কিন্তু যেখানে সংবিধানে পরিষ্কারভাবে ৯০ দিনের নির্বাচনকালীন সময়ের বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে, সেখানে সেই ৯০ দিন সময় শুরু হওয়ার পর কী করে তা ৪৫ দিনে কমিয়ে আনা সম্ভব, তা বোধগম্য নয়! সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের বিধানে নির্বাচন কমিশনকে সংসদ সদস্যের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। ১২৬ অনুচ্ছেদে নির্বাচনকালীন ৯০ দিনে রাষ্ট্রের সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নির্বাচন কমিশন নির্দেশিত দায়িত্ব মোতাবেক চলবে বলে সাংবিধানিক নিশ্চয়তা দেওয়া আছে। সে কারণে সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) ও ৭২(১) অনুচ্ছেদ দুটি প্রদত্ত ৯০ দিন শুরু হওয়ামাত্রই নির্বাচন কমিশনের এ দায়িত্ব পালনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা গণনা শুরু হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংসদের অধিবেশন বহাল রেখে নির্বাচনকালীন ৯০ দিনের সময় গণনা শুধু নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতাকেই কর্তিত করে না; বরং সংবিধানের মূলনীতি, চেতনা, ভাবার্থ ও জনগণের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারের প্রতিও এটা সরাসরি হুমকিস্বরূপ।

বিগত নবম সংসদ নির্বাচনের দেড় বছর আগেই কিন্তু রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছিল। অথচ বর্তমান নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচন সুচারুভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়ে জনমনে কেবল শঙ্কা বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বর্তমান নির্বাচন কমিশনও প্রতিদিন রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে তারাও সরকারের মতো করে সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে।

সম্প্রতি কমিশনের পক্ষ থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না বলে জানা যায়। বৈঠকে ইসির সঙ্গে দলগুলোর খোলামেলা মতবিনিময় হলে ইসির ঝামেলা হবে বলে তারা মনে করে। হঠাৎ কারো সঙ্গে না বসার ইচ্ছা কিসের আলামত তাও একটি প্রশ্নের বিষয়। সব দলকে নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের অগ্নিপরীক্ষায় বর্তমান ইসির এমন সিদ্ধান্ত অনেকটা আত্মঘাতী বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সঠিক পথে এগোতে হবে। নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে বিরোধী দলের মধ্যে যে আস্থার সংকট রয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠারও চেষ্টা চালাতে হবে।

হতাশার সঙ্গে বলতে হয়, স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই এরই মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। সংবিধানের দোহাই দিয়ে তারাও এমনভাবেই এগিয়ে চলেছে, যাতে বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিগত ইসি বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের আকাঙ্ক্ষায় একের পর এক চিঠি দিয়েও ক্লান্ত হয়নি। স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসির চোখে সরকারি বা বিরোধী- সব দলকেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন অবস্থানে রাখার পাশাপাশি সুষ্ঠু, সর্বদলীয়, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করাটা কারো দয়া বা অনুগ্রহের বিষয় হতে পারে না। এটা যেমন ইসির সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, তেমনি জনগণের মৌলিক অধিকারেরও বিষয়। এসবের প্রতিটিই ইসির অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সে শর্তেই তাদের নিযুক্তি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ইসির উচিত, সরকারি দলের পাশাপাশি অন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা করা এবং তাদের দাবি ও প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বদলীয় নির্বাচনের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া।

শোনা যাচ্ছে, ইসি যেকোনো দিন তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে। অথচ আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশ এক কঠিন ভয়াবহ সংঘাতের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এ অবস্থায় একদলীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা দেশে বিদ্যমান সংঘাতকে আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে। গত ডক্টর হুদা-ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত কমিশন যেকোনো একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে জোরালা অবস্থান নিয়েছিল। এ বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার (অব) সাখাওয়াত সমপ্রতি আমার সঙ্গে এক টক শোর আলোচনায় বলেন যে তিনি গত নির্বাচনে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন সব দল নির্বাচনে না এলে ইসি কোনো তফসিল ঘোষণা করবে না। আমরা বর্তমান ইসির কাছ থেকেও এ রকম অবস্থানই প্রত্যাশা করি। অনর্থক একদলীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবেন না। আমাদের নির্বাচন কমিশনাররা সব সরকারের আমলে কেন তাঁদের নিয়োগকর্তা সরকারি দলের আজ্ঞাবহের কাজ করেন? একজন অকৃতজ্ঞ নির্বাচন কমিশনার এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ