‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকবে না

সমকাল প্রতিবেদক
সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মত দিয়েছেন সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। গত ২ সেপ্টেম্বর সচিবদের সভায় আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সম্পর্কে বিশিষ্টজনরা বলেন, সরকারপ্রধান হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের জন্য প্রশাসনকে দিকনির্দেশনা তিনি দিতেই পারেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চরম আস্থাহীনতার সম্পর্ক এবং মন্ত্রী ও সাংসদের প্রশাসনযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি বিদ্যমান। ফলে সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখে নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকবে না। বিরোধী দলও এ ধরনের নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ কারণেই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে রাজনৈতিক অচলাবস্থা আরও ঘনীভূত
হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। ভালো দিক হচ্ছে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে জনপ্রশাসনকে বলেছেন। খারাপ দিক হচ্ছে, তিনি স্পষ্টই বলে দিলেন, দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। অথচ দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়ার বাস্তবতা নেই। বিরোধী দলও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মানে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এর ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা আরও বেশি সংকটজনক হবে।
প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের দিন-ক্ষণ নিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারপ্রধান হিসেবে এটা তিনি বলতেই পারেন। বিরোধী
দল বিএনপি বলছে, তারা প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা মানবে না_ এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার হক বলেন, বিরোধী দল না মানলে যা হবার তাই হবে। রক্তারক্তি হবে। অতীতেও যা হয়েছিল ভবিষ্যতেও তাই হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংবিধানসম্মতভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের ৯০ দিন আগে সংসদ থাকবে কি-না, সে বিষয়ে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংসদ বহল রেখে নাকি ভেঙে নির্বাচন দেওয়া হবে_ সংসদ অধিবেশন বসার আগেই প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে পরিষ্কার করেছেন।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সমকালকে বলেন, দলীয় সরকারের সঙ্গে দলীয় সাংসদদের রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর বিএনপি মহাসচিব বলে দিয়েছেন, আলাপ-আলোচনার সব পথ বন্ধ হয়ে গেল। এ পরিস্থিতিতে হয় একতরফা নির্বাচন হবে এবং সেটা হলে সহিংসতা, সংঘাত এড়ানো সম্ভব হবে না। তবে এখনও সময় আছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সংসদ ভেঙে দিলে অন্তত আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমঝোতার পথ তৈরি হলেও হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীও আগে বলেছিলেন, সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। সেটা করলে সংঘাতময় পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনার কথা বলেছেন। এটা দোষের নয়। বিশ্বের সব দেশেই এভাবে নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে, দলীয় সরকারে মন্ত্রী-এমপিদের দ্বারা প্রশাসন নিয়ন্ত্রিত হয়। মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের স্বপদে রেখে এ কারণেই নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবাধ নির্বাচন প্রায় অসম্ভব। আর একটা বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনে যেসব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক নেই। আস্থাহীন পরিবেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাই সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে না, নির্বাচনও গ্রহণযোগ্য হবে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী এর আগে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। এখন তার অবস্থান পরিবর্তন দেশবাসীকে তীব্র শঙ্কায় ফেলে দিয়েছে। এটা সবাই জানে, দেশে এমপিরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় জমিদারের মতো। এখন তারা যদি স্বপদে থেকে নির্বাচন করেন, তাহলে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। এখনও সুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী অন্তত সংসদ ভেঙে দেওয়ার পূর্বাবস্থানে ফিরে গিয়ে সমঝোতার পথ খুলে দিতে পারেন।