বাজেট ২০১৫–১৬

বিশাল বাজেটে রাজস্ব আদায়ের বড় লক্ষ্য

bbba

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট দেওয়া হচ্ছে আগামী ৪ জুন। টানা দুই মেয়াদে ১০ বছরে এটি হবে সপ্তম বাজেট। আর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নবম বাজেট।
আগামী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট হতে পারে ৩ লাখ ১০০ কোটি টাকার। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার। সে হিসাবে আগামী বাজেটের আকার ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ বা ৫০ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায় লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি থেকে কমিয়ে শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরের জন্য এনবিআর-নিয়ন্ত্রিত আদায় লক্ষ্যমাত্রা করা হতে পারে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। তার মানে ভবিষ্যতে এনবিআরকে বেশি আদায় করতে হবে ৪১ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানের ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে আগামী বাজেটে তা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে। আর ন্যূনতম আয়কর তিন হাজার থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে চার হাজার টাকা।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ঠিক করা হয়েছে ১ লাখ ৯৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের প্রকল্প রয়েছে ৩ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা। সেটি বাদ দিলে এডিপি হচ্ছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে গোটা বাজেটের আকারই ছিল ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা।
এডিপি বাদে বাজেটের আকারের বাকি অংশ হচ্ছে এনবিআরের মাধ্যমে সরকার কত টাকা সংগ্রহ করবে, বৈদেশিক অনুদান আসবে কত, ব্যাংকঋণ কত, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ কত পরিশোধ করতে হবে। সবকিছুর পর ঘাটতি থাকবে কত টাকার। এগুলোসহ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার, মূল্যস্ফীতি, ভর্তুকির চিত্রেরও রূপরেখা দাঁড় করিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখন কিছুটা ঘষা-মাজার কাজ চলছে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ, আর ঘাটতি হতে পারে ৮৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। সম্প্রসারণমূলক অর্থনীতির সমর্থনে অর্থমন্ত্রী বরাবরই বাজেট ঘাটতির পক্ষে। অর্থমন্ত্রীর এবারের দর্শনও তাই।
ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে ৩০ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে সরকারকে। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে করতে হবে ৫৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে আসবে ৩৮ হাজার ৩০৩ কোটি ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা: নতুন অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ১১ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা প্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হচ্ছে। এর মধ্যে এনবিআর-নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য থাকবে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
আয়কর থেকেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে চায় এনবিআর। আদায়ের লক্ষ্য ৬৫ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায় ধরা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। এ ছাড়া আমদানি, রপ্তানি, আবগারি, সম্পূরকসহ সব ধরনের শুল্ক থেকে আসবে ৪৬ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। এনবিআর-বহির্ভূত আদায় ও বিভিন্ন ফি মিলিয়ে ৩৫ হাজার এবং বৈদেশিক অনুদান হিসাবে আসবে আরও সাত হাজার কোটি টাকা।
৪১ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় কীভাবে করবে এনবিআর জানতে চাইলে ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহির প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই দেখছি কাগজে-কলমে লক্ষ্যমাত্রা কিছু একটা ঠিক করা হয়, পরে আবার তা সংশোধন করা হয়।’ তিনি বলেন, এনবিআর হয়তো নিজেও জানে যে এত টাকা আদায় করতে পারবে না। তবুও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। বলা যেতে পারে এটি একটি ‘সংখ্যা-খেলা’।
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমছে: নতুন অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী ৭ অথবা ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলবেন। বারবার লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েও ৬-এর ঘর পার হতে না পারার ব্যর্থতায় এবার লক্ষ্যমাত্রাই কমিয়ে ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে। চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সাময়িক হিসাব দিয়ে বলেছে, প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে বাজেটে ২০১৯-২০ অর্থবছরের মধ্যে প্রবৃদ্ধির হারকে ৮ শতাংশে উন্নীত করার একটি কৌশলের কথা বলা হবে বলে জানা গেছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবতা-বিবর্জিত প্রবৃদ্ধির উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রায় সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। তাই অহেতুক আশা সঞ্চারের কোনো মানে নেই। প্রবৃদ্ধির হার ৭ বা ৭ দশমিক ১ শতাংশ ধরা হলে তা অর্জনের দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন মির্জ্জা আজিজ।
ভর্তুকি ও প্রণোদনা সামান্য কমছে: অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, আগামী বাজেটে ভর্তুকি ধরা হচ্ছে ২৪ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতের বরাদ্দ ২৭ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা থেকে যা ২ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা কম।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরের ভর্তুকি ৯ হাজার ৬০১ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৩৩ হাজার ৫৬৬ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর থেকেই ভর্তুকির পরিমাণ কমছে। সার্বিক ভর্তুকি কমলেও বিদ্যুৎ ও খাদ্য খাতে ভর্তুকি বাড়ছে আগামী বাজেটে। বিদ্যুৎ খাতে চলতি অর্থবছরের ভর্তুকি ৭ থেকে বেড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা হচ্ছে। খাদ্য ভর্তুকি ১ হাজার ৬২০ কোটি থেকে হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বর্তমানে লাভ করছে। তারপরও এ খাতে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে ৮০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ভর্তুকি ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে তা কমিয়ে ৬০০ কোটি টাকা করা হয়।
কিছু নতুন বিষয়, কিছু পরিবর্তন: সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা প্রায় দ্বিগুণের সুপারিশ রয়েছে। আগামী বাজেটে বেতন বৃদ্ধির অংশটুকু বাস্তবায়িত করার চিন্তা রয়েছে সরকারের। ভাতা বাড়ানো হবে পরেরবার। বর্তমানে মূল বেতনের ওপর আয়কর দিতে হলেও ভবিষ্যতে তাঁদের তা দিতে হবে ভাতার ওপরও।
ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে, যেগুলোতে ১৪ হাজার মানুষ বসবাস করে। ছিটমহলবাসীদের জন্য বিদ্যালয়, রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি নির্মাণে সহায়তা করবে সরকার। বাজেটে এ বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা থাকছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু। তাদের নিয়ে প্রথমবারের মতো শিশু বাজেট নিয়ে কথা থাকছে আগামী বাজেটে। হাইব্রিড ইঞ্জিনযুক্ত রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির সুযোগও থাকছে। চা-বাগানের শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থার কথাও বলা থাকছে বাজেট বক্তব্যে। বাড়ছে পোশাক খাতে উৎসে কর। সামগ্রিকভাবে বাজেটে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত।