প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নাকচ বিএনপির

সমকাল প্রতিবেদক
সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে তাতে অংশ না নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে তারা। গতকাল জোটের মহাসচিব পর্যায়ের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত জানান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সমঝোতার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। আমরা স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত ১৮ দলীয় জোট মানছে না, মানছে না, মানছে না। এদিকে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর রাতেই দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। ‘দুর্বার গণআন্দোলনের’ মাধ্যমে যে কোনো মূল্যেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার নির্দেশ দেন তিনি। ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি’র জন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগই দায়ী থাকবে বলেও সাফ জানিয়ে দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। গতকাল ১৮ দলের মহাসচিবদের বৈঠকেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করেন নেতারা।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সঙ্গে সভায় বলেন, সংবিধান অনুসরণ করে সংসদ বহাল রেখেই আগামী নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকার থাকলেও নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে গতকাল প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। এর আগে সকালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জোটের মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠকে নেতারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বৈঠক শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের যে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন ১৮ দলীয় জোট তা প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে আমরা অংশ নেব না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, আগামী
নির্বাচন নিয়ে গতকাল প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে দেশের মানুষ কেবল হতাশাগ্রস্তই নয়, আরও বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এতদিন সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, এখনও সমঝোতার সুযোগ আছে। সংসদে আসুন, সেখানে আলোচনা করে সংকটের সমাধান করা যাবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সেই সুযোগের অবসান ঘটল।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন যদি প্রধানমন্ত্রীর শুভবুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে সংকটের সমাধান হতে পারে। তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার তৎপরতা হচ্ছে সরকারের ‘ক্ষমতা কুক্ষিগত’ করার অপপ্রয়াসের অংশ। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। সরকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তোয়াক্কা করছে না। তারা জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করার বিধান বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। অথচ সরকারপ্রধান বার বার বলে যাচ্ছেন, বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্বাচন হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্দলীয় সরকারের বাইরে নির্বাচন করা হলে এই অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলব। নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে।
আন্দোলনের কৌশল কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক কৌশল রয়েছে। তা যথাসময়ে জানানো হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে শূরার সদস্য রেদোয়ানউল্লাহ শাহেদী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের, এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, বিজেপি সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য খন্দকার সিরাজুল ইসলাম, জাগপা মহাসচিব খন্দকার লুৎফর রহমান, এনপিপি মহাসচিব ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এনডিপি মহাসচিব আলমগীর মজুমদার, ন্যাপ মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া, লেবার পার্টির মহাসচিব হামদুল্লাহ আল মেহেদি, মুসলিম লীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আতিকুল ইসলাম, অপর অংশের অ্যাডভোকেট জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আবদুল মালেক চৌধুরী, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবদুর রশীদ প্রধান, পিপলস লীগের মহাসচিব সৈয়দ মাহবুব হোসেন, ন্যাপ ভাসানীর হাসরত খান ভাসানী, ডেমোক্রেটিক লীগের সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, খোকন চন্দ্র দাশ, ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি মুহাম্মদ তৈয়ব, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি রেজাউল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সহদফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি, শামীমুর রহমান শামীম উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিষয় ছাড়াও চলতি মাসে নরসিংদী, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে খালেদা জিয়ার জনসভার প্রস্তু্তুতি, জোট নেতা মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের গ্রেফতার ও আপিল অবস্থায় যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ডিতদের ভোটাধিকার রহিত করাসহ বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
নির্বাচন প্রতিহতের অঙ্গীকার ১৮ দলের নেতাদের :সূত্র জানায়, ১৮ দলীয় জোটের মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠকে নেতারা যে কোনো মূল্যে একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সূত্র জানায়, বৈঠকে নেতারা বলেছেন, আওয়ামী লীগকে একদলীয় নির্বাচন করতে দিলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। এই প্রেক্ষাপটে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য দাবি আদায়ে চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করার পক্ষে মত দেন নেতৃবৃন্দ।
সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে খালেদার বৈঠক :সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত সোমবার ঘোষণার পর রাতেই দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। দলের নেতাদের তিনি বলেছেন, এখন কঠোর আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। সরকার সহজেই সমঝোতায় আসবে না।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া দলীয় নেতাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণার মাধ্যমে জনগণ ও বিরোধী দলকে বাজিয়ে দেখতে চান। সরকার এ অবস্থানে স্থির থাকতে পারবে না বলেও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তিনি। সরকার যদি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে ‘একদলীয়’ নির্বাচনের দিকেই যায়; জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করতে হবে।
এ ব্যাপারে আলাপকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীও বোঝেন যে, এ ধরনের নির্বাচন কেউ মানবে না। তা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা হয়তো সরকারের একটি কৌশল। তারা দেখতে চাইছেন জনগণ, বিরোধী দলসহ সংশ্লিষ্ট সব মহল বিষয়টি কীভাবে নেয়। কে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান সেটা দেখার জন্যই হয়তো এ ঘোষণা। তিনি বলেন, সরকার যদি জনমতের তোয়াক্কা না করে খেয়াল খুশিমতো নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় থেকে যেতে চায়, তাহলে জনগণ তা প্রতিহত করতে দৃঢ়সংকল্প। একদলীয় নির্বাচন জনগণ হতে দেবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সমকালকে বলেন, সরকারকে বলব, মানুষকে মানুষ মনে করতে শিখুন। এ দেশকে যদি জনগণের বলে বিশ্বাস করেন, তাহলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের গণদাবি মেনে নিন। না হলে দেশবাসী ওই নির্বাচন হতে দেবে না। একই সঙ্গে তিনি বলেন, একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করতে যা করা প্রয়োজন, জনগণ সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছে। জনগণের দল হিসেবে আমরা তাদের সঙ্গেই আছি।
মুফতি ওয়াক্কাসের গ্রেফতারের নিন্দা :এদিকে ১৮ দলের বৈঠকে মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাসের গ্রেফতারের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করা হয়েছে। বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, মুফতি ওয়াক্কাসের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি একজন বিজ্ঞ রাজনীতিক ও আলেম। তিনি সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। মিথ্যা অভিযোগে হয়রানি করতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।