পঞ্চদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ

পথ হারাবে না বাংলাদেশ…মতিউর রহমান

হেমন্তের এই দিনগুলো খুবই সুন্দর। আকাশ নীল, সাদা মেঘ, চারদিক ঝকঝক করছে আলোয় আলোয়। এদিকে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল দিচ্ছে একটার পর একটা জয়ের খবর, এনে দিচ্ছে আনন্দের উপলক্ষ। ঠিক এই সময়টাতেই প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা নিন। প্রিয় পাঠক, আপনারা সবাই ভালো থাকুন। আসুন, সবাই মিলেই ভালো থাকি। ভালো থাকুক এই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ!
এই চাওয়াটাই এখন আমাদের সবার চাওয়া। ভালো থাকুক বাংলাদেশ। এই উদ্বেগটাই এখন সবার মনে, বাংলাদেশ ভালো থাকবে তো! পথ হারিয়ে ফেলবে না তো!
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা বা রাজনীতিতে এক গভীর সংকট চলছে। সামনে আগামী তিন মাসের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন
হওয়ার কথা। ভোটের অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য দেশের মানুষ অপেক্ষায় রয়েছে এবং নির্বাচনে কোনো দলের বিজয় আর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা সরকার বাছাই করতে পারব কি না।
আমরা জানি, বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে ভালো আর কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সে জন্য এখনো আশায় বুক বেঁধে আছি যে, সব দলের অংশগ্রহণে ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাব।

কিন্তু আমাদের এই আশাবাদ কতটুকু বাস্তবসম্মত? সত্যি সে আশা বা সম্ভাবনা এখনো দেখা যায় না। বরং বিগত দুই দশকের সহিংস রাজনীতি থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, সেটাই এখন দেশের মানুষের বড় দুশ্চিন্তার কারণ। এসব নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। কিন্তু সামনে তেমন কোনো আশার আলো দেখা যায় না। আজ থেকে আবার ৬০ ঘণ্টার হরতাল শুরু হলো। এ জন্য জেএসসি পরীক্ষা পেছাতে হলো। প্রায় ২০ লাখ পরীক্ষার্থী সমস্যায় পড়ে গেল।

আমাদের সব দুশ্চিন্তা আর সংকট যেমন সত্যি, তেমনি আমরা দেখি বিগত দুই দশক ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। সব সরকারের সময় ধরেই বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা চলেছে। বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বড় রকমের অগ্রগতি হচ্ছে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো এ জন্য বাংলাদেশকে প্রশংসা করছে, স্বীকৃতি দিচ্ছে, পুরস্কৃত করছে।

মানব উন্নয়ন সূচকের অনেকগুলোয় বাংলাদেশ খুবই ভালো করেছে। সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজির অনেকগুলোতেই আমাদের অর্জন দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। এখন দেশের ৯৮ ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৯০-এ ছিল হাজারে ৫৭৪, ২০১১-তে নেমে হয়েছে ১৯৪, শিশুমৃত্যুর হার ১৯৯০-এর হাজারে ১৪৬ জনের তুলনায় ২০১১-তে নেমে এসেছে ৫৩ জনে। দারিদ্র্য কমেছে, ১৯৯০ সালের শতকরা ৪৭.৫০ ভাগের তুলনায় এখন দারিদ্র্য কমে হয়েছে ৩১.৫০ ভাগ। টিকাদান কর্মসূচিতে আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের গড় আয়ু ১৯৮০ সালের তুলনায় ১৪ বছর বেড়ে হয়েছে ৬৯ বছর। এটা ভারতের গড় আয়ু ৬৫-এর তুলনায় বেশি।

দেশে মুঠোফোনের গ্রাহকের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। তিন কোটির বেশি লোক এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করছে আমাদের তরুণেরা।

বাংলাদেশের এই অগ্রগতির স্বীকৃতি আর প্রশংসা মিলেছে দেশে-বিদেশে। নোবেল বিজয়ী বাঙালি অমর্ত্য সেন ক্রমাগতভাবে বলছেন, বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ভালো করছে ভারতের চেয়েও। তিনি তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যান আনসারটেইন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশনস গ্রন্থে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ও রেখেছেন। সেখানে অমর্ত্য সেন লিখেছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা, জবাবদিহির অভাব, বিরোধী দলের সংসদ বয়কটের মতো নানা ধরনের সমস্যার মধ্যেও বাংলাদেশ গত দুই দশকে অনেক সামাজিক সূচকেই ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।

আট বছর ধরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৬ শতাংশের বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতিতে ছাড়িয়ে যাবে ইউরোপের বহু দেশকে। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্সের সাবেক চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ জিম ও নিলকে যখন ব্রিকের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন) পরে নেক্সট ইলেভেন বা পরবর্তী ১১টি সবচেয়ে সম্ভাবনাপূর্ণ দেশ বেছে নিতে বলা হয়, তিনি বাংলাদেশকে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।

আর বাংলাদেশ সম্পর্কে এই উচ্চ ধারণার কারণগুলোও তাঁরা ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেন বাংলাদেশের মানবসম্পদের ওপরে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬০ ভাগই তরুণ, এটাকেই তাঁরা মনে করেন বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় কারণ। এবং বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে সচেষ্ট রয়েছে।

শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে এগিয়েই চলেছে, তার মূলে রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের বহুমুখী কার্যক্রম। বাংলাদেশের কৃষিতে বিপ্লব ঘটে গেছে, গত ৪২ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, জমি কমেছে, কিন্তু বাংলাদেশের কৃষক আমাদের মুখে অন্ন জুগিয়েই চলেছেন। প্রবাসী শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাঠিয়ে যাচ্ছেন মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা, বিশ্বমন্দার সময়েও আমাদের অর্থনীতিকে যা রেখেছে উজ্জীবিত। আমাদের পোশাকশ্রমিকেরা নিজেদের শ্রমে-ঘামে সক্রিয় রেখেছেন আমাদের অর্থনীতির চাকা, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সারা বিশ্বে আমাদের অবস্থান তৃতীয়, ভারত যেখানে ষষ্ঠ। গত ২০১২-১৩ অর্থবছরে কেবল পোশাক রপ্তানি করেই বাংলাদেশ পেয়েছে দুই হাজার ১৫১ কোটি ডলার বা এক লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। আর একই সময়ে প্রবাসী-আয় এসেছে এক হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার বা এক লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার (এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা) বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে বাংলাদেশ যে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে, এর বড় কৃতিত্বই আমাদের পোশাক আর প্রবাসী শ্রমিকদের। এক সময়ের সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে ক্রিকেট, বাংলাদেশের তারুণ্যের বিজয় পতাকা উড়ছে সর্বত্র। ঘরে-বাইরে, মাঠে-ঘাটে, অফিসে-আদালতে সর্বত্র নারী-পুরুষ কাজ করছে পাশাপাশি, কাজ করে চলেছে নিজের উন্নতির জন্য, যা আসলে উন্নতি ঘটাচ্ছে পুরো দেশেরই। সরকার, বেসরকারি সংগঠন, বিভিন্ন উদ্যোক্তার নানা ধরনের সৃজনশীল উদ্যোগ, ব্যক্তি ও সম্মিলিত মানুষের নিষ্ঠা, শ্রম, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতার অপূর্ব সমন্বয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।

আমরা জানি, আমাদের এই উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হতে পারত। আমরা আরও বহুদূর এগিয়ে যেতে পারতাম, যদি দেশের রাজনীতি এত সংঘাতময় হয়ে না থাকত, যদি আমরা সুশাসন পেতাম, যদি আমাদের দেশে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যেত, যদি আমাদের প্রশাসন হতো আরও দক্ষ, যদি লাল ফিতার বাঁধন আমাদের পথে পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করত। কাজেই সুশাসনের জন্য, দুর্নীতিকে সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনা ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য আমাদের ক্রমাগতভাবে লড়াই করে যেতে হবে, আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।

পাশাপাশি নানা সংকটে, নানা ক্রান্তিলগ্ন্নে মানুষই এগিয়ে এসেছে উত্তরণের কোনো না-কোনো সৃজনশীল পথ উদ্ভাবন করতে। আর রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও যে আমরা ভেঙে পড়ি না, তার কারণও এই দেশের সাধারণ নারী-পুরুষ খেটে খাওয়া মানুষ, বাংলাদেশের কৃষক কখনো ধর্মঘট করেননি, বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকেরা কখনো হরতাল করে বসেননি।

বর্তমান সময়কালে আমরা যে একটা নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই প্রদোষকালও আমরা অতিক্রম করব। আলোর পথেই চলবে বাংলাদেশ। উন্নয়নের পথেই দেশকে এগিয়ে নেবে সাধারণ মানুষ, ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিতভাবে। আমাদের মাঝেই আছেন পলান সরকার, যিনি জীবনভর বিনা পয়সায় বই পড়িয়ে আলোকিত মানুষ গড়ে চলেছেন। আমাদের মধ্যেই আছেন আরজিনা বেগম, যিনি মুষ্টি চাল দিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে দারিদ্র্য জয় করেছেন। আছেন বৃক্ষপ্রেমী কার্তিক পরামানিক, কিংবা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা রিকশাচালক জয়নাল আবেদিন। আমাদের আছে ক্রিকেটার সোহাগ গাজী, সাকিব আল হাসান, গলফার সিদ্দিকুর রহমান। আমাদের মধ্যেই আছেন এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীম, নিশাত মজুমদার আর ওয়াসফিয়ারা।

আমরা উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই, বাংলাদেশ পথ হারাবে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশ তার সব কটি মৌলিক মূল্যবোধ নিয়েই এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, সমপ্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতি আর নারী-পুরুষের সমমর্যাদার পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। এই দেশের উন্নতিও কেউ আটকে রাখতে পারবে না। সংকটের যে মেঘ দেখা দিয়েছে আকাশে, তা কেটে যাবেই। বাংলাদেশে সূর্য উঠবেই। আলোয় আলোয় ভরে উঠবে দেশ। বাংলাদেশ বিজয়ী হবেই।

বিজয়ের পথে বাংলাদেশের এই অভিযাত্রায় দেশের সব মানুষের সঙ্গে প্রথম আলোও থাকবে বিনীত এক সহযাত্রী হিসেবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা ওয়েবপেজ হিসেবে আলোর দিকেই থাকবে আমাদের মুখ, আমাদের ছায়া কখনোই যেন আমাদের সামনে না পড়ে, সেদিকে আমরা থাকব সদাসতর্ক। নিরপেক্ষ সাহসী বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মাধ্যমেই আমরা আমাদের কর্তব্য পালন করে যাব, যে কর্তব্যের একটা হলো মানুষের মনে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখা। সে জন্যই আমরা বারবার বলব, পথ হারাবে না বাংলাদেশ।

আবারও সবাইকে শুভেচ্ছা।