নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করছে বিএনপি

রেজা মাহমুদ
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনী প্রস্তুতিও এগিয়ে রাখছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে দলটি তাদের আগামী নির্বাচনের ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু করেছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশনায় তৈরি করা হচ্ছে এ ইশতেহার। তবে এ ইশতেহারের বড় একটি অংশজুড়ে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের চিন্তাভাবনা ও দিকনির্দেশনা থাকছে বলে জানা গেছে। ইশতেহারের খসড়া লিপিবদ্ধ করার প্রাথমিক কাজ চলছে কয়েকদিন ধরে। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক সময়ের ঘোষিত ‘নতুন ধারার রাজনীতি’ ও ‘নতুন ধারার সরকার’-এর ধারণার ভিত্তিতেই তৈরি হচ্ছে দলটির নির্বাচনী ইশতেহার। বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেছেন, ‘নতুন ধারার রাজনীতির অঙ্গীকার আমাদের আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে থাকছে। আমরা ক্ষমতায় গেলে এটা অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় গেলে যতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে ততটুকু ওয়াদাই বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে রাখা হচ্ছে। ইশতেহারে সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে আমাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও পরিকল্পনা। যাতে ক্ষমতায় গেলে জনগণ দেখতে পারে আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি কি-না।’
দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির নির্বাচনের প্রস্তুতি সবসময়ই আছে। সরকার নির্দলীয় ব্যবস্থা মানব না বলে গো ধরে আছে। কিন্তু হঠাৎ
যদি তারা দাবি মেনে নিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেয় তাহলে যাতে পিছিয়ে না পড়ি সে ব্যাপারে সব ধরনের প্রস্তুতিও আমরা নিয়ে রাখছি।’
ইশতেহার তৈরিতে জড়িত যারা : দলীয় নেতাদের মধ্যে ইশতেহার তৈরির সঙ্গে আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আরএ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, ড. আবদুল মঈন খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শওকত মাহমুদ প্রমুখ। থিঙ্কট্যাঙ্কের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন সাবেক ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, কয়েকজন সাবেক সচিব, একটি দৈনিক পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ও কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক। এ ছাড়া ইশতেহারের বিভিন্ন খাতওয়ারি পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রুতি সুনির্দিষ্টভাবে সনি্নবেশ করতে সংশ্লিষ্ট খাতের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন পেশাজীবী নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, তারেক রহমান বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারের একটি বড় অংশের পরিকল্পনা করে রেখেছেন। লন্ডনে চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি তিনি দেশের উন্নয়নে সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও অধ্যয়নরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের উন্নয়নের ‘নতুন’ রূপকল্প তৈরি করছেন তিনি। বিএনপির ‘নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার’ ধারণার বড় অংশজুড়ে রয়েছে তারেক রহমানের এসব চিন্তাভাবনা। নির্বাচনী ইশতেহারেও থাকছে এর প্রতিফলন। তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে এ তথ্য।
নির্দেশনা অনুসারে ইশতেহারের প্রাথমিক খসড়া তৈরির কাজ সমাপ্ত হলে তারপর দলীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে সিনিয়রদের এটা চূড়ান্ত করার কাজে সম্পৃক্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার এ ব্যাপারে সমকালকে বলেন, ‘সুশাসন ও উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনা থাকছে দলের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে।’ তবে তিনি এখনও নতুন ইশতেহার তৈরির কাজে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পৃক্ত হননি বলে জানান।
যা থাকছে নির্বাচনী ইশতেহারে : বিএনপির আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে থাকছে ‘নতুন ধারা’র পরিপূর্ণ ধারণা। এ ইশতেহারে সরকার, সংসদ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, কৃষি, পররাষ্ট্রনীতিসহ সরকারের প্রতিটি বিভাগে নতুন ধারার ধারণার আলোকে পরিকল্পনাগুলো সনি্নবেশিত রাখা হচ্ছে। মেধার পরিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে চাকরিতে কোটা পদ্ধতির আওতা কমিয়ে আনা, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে দলীয়করণের অবসান ঘটিয়ে মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, শিক্ষা ও কৃষি খাতে যুগোপযোগী সংস্কারের মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা, কৃষকদের সহজশর্তে ঋণদান, শিক্ষা ব্যবস্থাকে কর্মমুখী করা, হানাহানি, বিভক্তি ও বিভাজনের রাজনীতির অবসান, বিরোধী দলকে সত্যিকার অর্থেই বিকল্প সরকারের মর্যাদা দেওয়া, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার ক্ষেত্রে সহজে ঋণপ্রাপ্তির নিশ্চয়তাসহ ইতিবাচক সব অঙ্গীকার থাকছে এ নির্বাচনী ইশতেহারে। শিগগিরই এ ইশতেহারের খসড়া তৈরি সম্পন্ন করা হবে। এরপর দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে খসড়াটির খুটিনাটি বিশ্লেষণ শেষে তা চূড়ান্ত করবেন খালেদা জিয়া।
নতুন ইশতেহার নিয়ে বিএনপির আশাবাদ : বিএনপির হাইকমান্ড, নীতিনির্ধারক ও ‘থিঙ্কট্যাঙ্ক’ থেকে নতুন এ ধারণার ব্যাপারে অত্যন্ত উচ্চাশা পোষণ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে বিরোধী দলের ওপর সব ক্ষেত্রে খৰহস্ত হয়েছে সেখানে বিএনপির অহিংস ধারণাটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাবে। এ স্ল্নোগানের অংশ হিসেবে খালেদা জিয়া ‘বিভাজন ও প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা নয়, আওয়ামী লীগকে সঙ্গে নিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করব’ বলে যে নীতির ঘোষণা দিয়েছেন তা সুশীল সমাজসহ সব ভোটারকেই খুশি করবে। দলীয়করণের পরিবর্তে মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন করার যে অঙ্গীকার এতে থাকছে তা সব মহলের প্রশংসা কুড়াবে বলেই বিশ্বাস বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও ইশতেহার তৈরির সঙ্গে জড়িত বুদ্ধিজীবীদের। বিএনপি নেতৃবৃন্দ ও দলটির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশাসনের দক্ষ ও যোগ্য আমলাদের ব্যাপকভাবে ওএসডি করে রাখলে প্রশাসনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়, দেশের অগ্রগতি থেমে যায়, স্থ্থবিরতার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থ্থায় বিএনপির দলীয়করণ না করার প্রতিশ্রুতি মানুষকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করবে।
আলাপকালে ড. মোশাররফ বলেন, ‘মানুষ এ সরকারের দুঃশাসন দেখতে চায় না বলেই ৫ সিটিতে তাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। টেন্ডারবাজি, বিভাজনের রাজনীতি, দুর্নীতি, দুঃশাসনের স্থ্থলে খালেদা জিয়া নতুন ধারার মাধ্যমে সুশাসনের যে ওয়াদার কথা বলছেন তা সব মানুষই ইতিবাচকভাবে দেখবে বলে বিশ্বাস করি। এ সরকার সব বিভাগকে দলীয়করণ করে দেশটাকে অকার্যকর করে ফেলেছে। মানুষ এ থেকে মুক্তি চায়। চেয়ারপারসন দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন ও বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ঘোষণা করে মানুষকে কাঙ্ক্ষিত সেই মুক্তির পথই দেখিয়েছেন। এ কারণেই জনগণ আমাদের পাশে থাকবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী।’