দুর্বল রুপি, সবল টাকা

মামুন রশীদ
ভারতের মুদ্রা রুপির দাম মার্কিন ডলারের তুলনায় ক্রমাগত কমছে। নিকট ভবিষ্যতে রুপি আগের অবস্থানে ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। এর কয়েকটি কারণ_ যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেওয়া কিছু উৎসাহব্যঞ্জক প্যাকেজ প্রত্যাহার করে নেওয়ার সম্ভাবনা। বিদেশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা অব্যাহতভাবে ভারত থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে কিংবা ‘ভারতীয় অ্যাসেট’ থেকে অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে রয়েছে ক্রমবর্ধমান বাজেট ও চলতি হিসাবে ঘাটতি এবং চড়া হারে মূল্যস্ফীতি। আগামী বছরের প্রথম দিকে দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার ফল নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা।
অন্যদিকে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা অব্যাহতভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। একসময় ১ ডলার ভাঙিয়ে ৮৪ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যায় ৭৭ টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন_ আমদানি তুলনামূলক কম হওয়া, রফতানি বাণিজ্য এবং প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ প্রায় স্থিতিশীল থাকার কারণেই টাকা এমন শক্ত অবস্থানে থাকতে পারছে। যদি আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের মান ধরে রাখার জন্য অব্যাহত সমর্থন না জোগাত, তাহলে ১ ডলার ভাঙিয়ে সম্ভবত ৭০ টাকা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো বলে কেউ কেউ মনে করেন। ডলারের মান ধরে রাখার জন্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ৪৫০ কোটি ডলারের বেশি কিনেছে। আন্তঃব্যাংক বাজার থেকে তারা ডলার কেনা অব্যাহত রেখেছে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পে কিছু অস্থিরতা রয়েছে এবং এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত তাদের বস্ত্র শিল্পজাত পণ্যের রফতানি বাড়াতে সচেষ্ট বলে বিভিন্ন সূত্রের খবর। এ জন্য তারা রফতানিকারকদের বাড়তি সুবিধা প্রদানেও আগ্রহী। রুপির দর পড়ে যেতে থাকা এ ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে সরকারি সহায়তা বরাবরই ছিল। তবে সম্প্রতি সময়ে এ শিল্পের জন্য যে ধরনের সমন্বিত নীতি ও কর্মকৌশলের প্রয়োজন ছিল, তাতে ঘাটতি রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। বন্ডেড ওয়ার হাউস সুবিধা উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন, কিন্তু নগদ আর্থিক সহায়তা অব্যাহতভাবে কমছে। তৈরি পোশাকশিল্প প্রথম থেকেই স্বল্প হারে কর দিচ্ছে। কিন্তু এখন উৎসে কর বেড়েছে। পাকিস্তান যেখানে এক্সচেঞ্জ রেট গ্যাপ সাপোর্ট বা প্রতি ডলার রফতানির জন্য রফতানিকারকদের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ বিষয়টি বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে রেখেছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশ ২০১৩ অর্থবছরে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু চলতি বছরে রফতানি ১২ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার অর্থনীতি এখনও স্বাভাবিক নয়। তারপরও গত বছর আমাদের পোশাক রফতানি ১১ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিশেষ সরকারি প্রণোদনা ব্যতিরেকে এ বছর তা আরও ১২ শতাংশ বাড়ানো খুব কঠিন কাজ। বিশেষ করে প্রতিবেশী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত তার পোশাক রফতানিকারকদের বাড়তি সুবিধা দিতে উদ্যোগী হয়েছে। আমাদের পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং ওষুধ ও সফটওয়্যার রফতানি খাত ভালো করছে। কিন্তু রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর তৈরি পোশাকশিল্প খুব একটা ভালো সংকেত দিচ্ছে না। ২০১২ অর্থবছরে পোশাক রফতানি ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু গত বছর ২৩ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার পরিবর্তে অর্জিত হয়েছে ২১.৪ বিলিয়ন ডলার। সরকার যথাযথ ভূমিকা না রাখলে এ বছরেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। পোশাকশিল্পের পরিবেশ উন্নত করার জন্য বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার লক্ষণ নেই। শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর জন্য দাবি জানাচ্ছেন। এ অবস্থায় মালিকরা সরকারের দিক থেকে যথার্থভাবেই কিছু নীতিগত সমর্থন চাইছেন। এ প্রেক্ষাপটেই রুপির দাম কমছে এবং বাড়ছে টাকার দাম। বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকদের উদ্বেগ তাই বোধগম্য।
ভারত বাংলাদেশি পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের পর সেখানে রফতানি বাড়তে শুরু করেছে। গত বছর সেখানে রফতানি ছিল ৫৬.৪ কোটি ডলার, যা তার আগের বছর ছিল ৪৯.৮ কোটি ডলার। একই সময়ে ভারতে আমাদের পোশাক রফতানি ৫.৫ কোটি ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৭.৫ কোটি। তবে ভারতের রুপির দরপতনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি হুমকির মুখে পড়তে পারে। ভারতের রুপির দাম কমতে থাকায় ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কেউ কেউ তো বলছেন, দুই দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে প্রায় সমান হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ এক ডলার ভাঙিয়ে যত টাকা মিলবে, প্রায় সমপরিমাণ মিলবে ভারতীয় রুপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের মতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রফতানিকারক ও প্রবাসীদের নানাভাবে সমর্থন দিচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত রফতানিকারকদের আরও কিছু সুবিধা প্রদান প্রয়োজন। শুল্ককর সুবিধা, সুদের হারে সুবিধা কিংবা এ ধরনের আরও সুবিধার কথা অবশ্যই ভাবতে হবে আমাদের।
স অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
সৎধংযরফ১৯৬১@মসধরষ.পড়স