টেলিফোনে আলোড়িত দুনিয়া…কামাল আহমেদ

টেলিফোন নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বময় যে তোলপাড় চলছে, এমন সংকটের কথা টেলিফোনের আবিষ্কর্তা হিসেবে ১৮৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট পাওয়া আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল দুঃস্বপ্নেও দেখেছিলেন কি না, সন্দেহ আছে। গোড়াতেই বলে রাখা ভালো যে, আমি বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের কথাই যে শুধু বলছি, তা নয়। টেলিফোন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যতটা পেরেশান, তার চেয়েও অনেক বেশি পেরেশান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এরপর আছেন বিশ্বব্যাপী আড়ি পাতার ঠিকাদারিতে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান জিসিএইচকিউয়ের কর্তৃত্বের অধিকারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পেরেশানিতে আছেন ইউরোপের ক্ষমতাধর দুই নেতা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ এবং জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। এর সঙ্গে সর্বসম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয়।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোর রাষ্ট্রনেতা ও রাজনীতিকেরা টেলিফোনবিষয়ক যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তা মূলত গুপ্তচরবৃত্তির অংশ হিসেবে ফোনে আড়ি পাতা এবং এ ক্ষেত্রে সবার অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সর্বসাম্প্রতিক খবর হচ্ছে, জার্মানি ও ব্রাজিল যৌথভাবে জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়েছে, যাতে সেখানে টেলিফোনের আলাপচারিতা এবং ই-মেইলের ক্ষেত্রে ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার রক্ষায় একটি বৈশ্বিক সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ফোনে আড়ি পাতা নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও বিতর্কের কোনো শেষ নেই। ইউরোপীয় মিত্রদের টেলিফোনে আড়ি পাতার তথ্য ফাঁস হওয়ার পর আটলান্টিকের দুই তীরের সম্পর্কের ওপর সন্দেহের যে কালো ছায়া বিস্তৃত হয়েছে, তার পটভূমিতে ওয়াশিংটনে কংগ্রেস কমিটিতে হাজির হয়ে গুপ্তচর দপ্তরের প্রধানকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও বিতর্কের ইতি ঘটেনি। শেষ পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, তাঁদের গুপ্তচরেরা নজরদারির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। আর প্রেসিডেন্ট ওবামা ইতিমধ্যেই এই কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য নির্দেশ জারি করেছেন।
টেলিফোন নিয়ে বিপত্তির আরেকটি বড় নাটকের অনেক অজানা তথ্য এখন ক্রমেই প্রকাশিত হচ্ছে লন্ডনের একটি আদালতে। এখানেও মূল অভিযোগ, বেআইনিভাবে টেলিফোনে অন্যের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া। ব্রিটেনের এই অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে বিলুপ্ত পত্রিকা নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর সাবেক দুই সম্পাদক, কয়েকজন সাংবাদিক এবং তাঁদের ভাড়া করা গোয়েন্দা। আর ওই দুই সম্পাদকের একজন আবার প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সাবেক তথ্য কর্মকর্তা এবং অপরজন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কারও টেলিফোন থেকে বেআইনিভাবে তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার এই অপকর্ম থেকে ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে শুরু করে রাজনীতিক, তারকা ব্যক্তিত্ব; এমনকি সাধারণ মানুষও রেহাই পাননি। ফলে ‘ফোন হ্যাকিং’ নামে পরিচিত এই কেলেঙ্কারির বিষয়টি যে শুধু আদালতেই বিচারাধীন তা নয়, বরং এর পরিণতিতে ব্রিটেনের সংবাদপত্রজগতের শতবর্ষের রীতিনীতিতেও পরিবর্তন আসছে। গত বৃহস্পতিবার রাজকীয় এক সনদ (রয়্যাল চার্টার) জারির বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন রানি এলিজাবেথ।
সংবাদপত্রগুলোর জন্য অবশ্যপালনীয় কিছু আচরণবিধির নির্দেশনা রয়েছে এই রাজকীয় সনদে। প্রধান তিন রাজনৈতিক দল— কনজারভেটিভ, লেবার ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সমঝোতার ভিত্তিতে প্রণীত এই আচরণবিধি ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলে অনুমোদিত হওয়ার পর রানি তাতে সম্মতি দিয়েছেন। এই সনদের আওতায় একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে, যারা সংবাদপত্রগুলো আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের ভিত্তিতে তা প্রতিকার করবে।
আগে এই কাজটি করত সংবাদপত্রশিল্পের মালিক ও সম্পাদকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন (পিসিসি)। কিন্তু বাস্তবে কোনো সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে তার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। উপরন্তু সংবাদপত্রশিল্পের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকায় সেখানে স্বার্থের সংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) বিষয়টি অস্পষ্ট ছিল। এখন রাজকীয় সনদে নতুন যে প্রতিষ্ঠানকে এই দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটিতেও রাজনীতিকদের প্রভাব ফেলার পথ বন্ধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। তার পরও সংবাদপত্রগুলোর জন্য এই সনদে অংশগ্রহণ অর্থাৎ নতুন প্রতিষ্ঠানের তদারকি মেনে নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সংবাদপত্রগুলো এই সনদের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তবে সে জন্য তাদের প্রয়োজনে তারা সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা চাইতে পারবে না। প্রধান প্রধান সংবাদপত্র ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, তারা এই রাজকীয় সনদ গ্রহণ করবে না, বরং নিজেরাই নিজেদের ভুলভ্রান্তি বিচারের বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে।
বাংলাদেশে টেলিফোনের একটি বাংলা শব্দ সরকারিভাবে চালু আছে, যেটা আমারও খুব পছন্দ। শব্দটি হলো ‘দূরালাপনি’। দূরালাপনি ব্যবহার করে যে আলাপ হয়, তাকে দূরালাপ বা দূরালাপন বলা বোধ হয় তাই অন্যায় হবে না। দুই নেত্রীর দূরালাপন নিয়ে দেশের ভেতরে যে বিতর্কের ঝড় উঠেছে, তার রেশ যে শুধু বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই আটকে আছে তা নয়, সীমানার বাইরেও তার প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়।
দুই নেত্রীর দূরালাপনে নাটকীয়ভাবে দূরত্ব ঘুচবে—এমনটি কেউ আশা না করলেও একটি সংলাপের সূচনা সবাই আশা করেছিলেন। সে কারণেই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের বিবৃতিতে কূটনৈতিক ভাষায় তাঁর হতাশার কথা প্রকাশিত হয়েছে। যদিও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সব সময়ই অন্য রাজনীতিকদের মতোই চাঁচাছোলা বক্তব্য এবং প্রতিপক্ষের প্রতি কটাক্ষ আর অবমাননাকর মন্তব্যে অভ্যস্ত, বাস্তবে কিন্তু কূটনীতির ভাষা হয় অত্যন্ত মার্জিত এবং শালীন। তাঁরা তাঁদের হতাশা বা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন এমন ভাষায়, যাতে তাঁদের নৈরাশ্য প্রকাশ না পায়। বান কি মুনের বিবৃতিতে তাই সম্প্রতি সূচিত সংলাপের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার আশা প্রকাশে মূলত তাঁর হতাশাই প্রতিফলিত হয়েছে। তা না হলে সহিংসতার জন্য তাঁর বিবৃতিতে যেমন উদ্বেগ জানাতে হতো না, তেমনি গ্রহণযোগ্য এবং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বানও থাকত না।
দুই নেত্রীর সংলাপের বিষয়ে ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকেরাও তাই একই ধরনের ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছেন। অবশ্য পত্রিকান্তরের খবর অনুযায়ী আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশি কূটনীতিকদের কূটনৈতিক শালীনতা বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এই পরামর্শটা কতটা শালীন হয়েছে, সেই প্রশ্ন তোলাটা তাই কোনোভাবেই অযৌক্তিক হবে না। বিদেশিদের পরামর্শ দেওয়ার আগে আমাদের রাজনীতিকদের উচিত বিদেশে থাকা নিজেদের দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পরামর্শ দেওয়া যে তাঁরা যেন লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করা থেকে বিরত থাকেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস ভার্সি যখন হাউস অব লর্ডসে বলেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধের প্রতিফলন আমরা পূর্ব লন্ডনের রাস্তায় দেখতে চাই না, তখন কি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলবেন যে ব্রিটিশ মন্ত্রী শালীনতা লঙ্ঘন করেছেন?
দুই নেত্রীর সংলাপের পর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ লন্ডনে যে সংক্ষিপ্ত সফরে আসেন, সে সময় তাঁর সম্মানে আয়োজিত একাধিক অনুষ্ঠানে যেসব প্রবাসী হাজির হয়েছিলেন, তাঁদের আলোচনাতেও দুই নেত্রীর দূরালাপনের বিষয়টি শোনা গেছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবটাই হতাশার কথা।
দূরালাপনে যে দূরত্ব বেড়েছে, সেটা কেবল ঘোচাতে পারে মুখোমুখি আলোচনা এবং সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুই নেত্রীর কেউই সেই আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে পারেননি। বরঞ্চ তাঁদের সব পদক্ষেপেই রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের স্থূল কৌশল অনুসরণের প্রতিফলন ঘটেছে। পুরো আয়োজনের অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা তারই সাক্ষ্য বহন করে। যেখানে সাংসদেরাও কারও সঙ্গে কথা বলার আগে তাঁদের ব্যক্তিগত সহকারীরা টেলিফোনে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে মিলিয়ে দেন, সেখানে এ ধরনের কোনো প্রটোকলের অনুপস্থিতি প্রশ্নাতীত নয়। দূরালাপনের প্রয়োজনে গত দুই যুগে দুই নেত্রীর মধ্যে যে লাল টেলিফোন একবারও ব্যবহূত হয়েছে কি না সন্দেহ, মুঠোফোনের যুগে সেই লাল টেলিফোনই হয়ে গেল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যোগাযোগের মাধ্যম। অতঃপর টেলিভিশন ক্যামেরার উপস্থিতিতে কথোপকথন এবং তার রেকর্ড সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হওয়া—এগুলো ওই আলোচনার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে আরও অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
যে দেশে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও বিত্তের কারণে বৈষম্যের অভিযোগ আর কাউকে বিস্মিত করে না, সে দেশে তাই ফোনালাপ ফাঁস করায় কাউকে জেলে যেতে হয়, আর কারও কারও সমর্থনে ক্ষমতাসীনেরা সোচ্চার হন। অবশ্য এ কথা বলে রাখা ভালো যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিধায় ব্যক্তিগতভাবে আমি এ ধরনের ফোনালাপ প্রকাশের বিরুদ্ধে নই। সংবাদমাধ্যমের হাতে এ ধরনের রেকর্ড এলে
সেটা তাদের ছাপার অধিকার অবশ্যই আছে এবং সেটা প্রকাশ করা অপরাধ হতে পারে না। তবে যাঁরা ফাঁস করেছেন, তাঁদের অপরাধ এতে মাফ হয় না।
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।