লক্ষ্য পূরণে ৭০টির ৬৩টিই ব্যর্থ

অমঙ্গলের থাবা মা ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্রে

ma

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন মা ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্রগুলো চলছে না। অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক বছরে ৭০টি কেন্দ্রের ৬৩টিই নিরাপদ মাতৃত্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কমপক্ষে ২৪টি কেন্দ্রের একটিতেও অস্ত্রোপচার হয়নি। স্বাভাবিক প্রসবের হারও ছিল হতাশাব্যঞ্জক।

অধিদপ্তর কমপক্ষে ১০০টি প্রসবের লক্ষ্যমাত্রা প্রতিটি কেন্দ্রকে বেঁধে দিয়েছিল। কাগজে-কলমে জেলা পর্যায়ে ৬০টি, উপজেলায় আটটি ও ইউনিয়নের দুটি মাতৃ ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র থেকে ‘সম্প্রসারিত’ সেবা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময়ে নারী নিরাপদে এসব কেন্দ্রে স্বাভাবিকভাবে বা প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করতে পারবেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা পর্যায়ের মাতৃ ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্রগুলো দূরে থাক, অধিদপ্তরের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আজিমপুর মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেও (আজিমপুর মাতৃসদন) বেলা আড়াইটার পর জরুরি প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব করা যায় না।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা দেশের ১০টি জেলার মাতৃ ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন সেখানে দালালের উৎপাত, চিকিৎসক অনুপস্থিত এবং অবকাঠামো দুর্বল। বেশির ভাগ কেন্দ্রের বিছানা ছিল ফাঁকা। ওই একই সময়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় ছিল উপচেপড়া ভিড়।

এদিকে ৬৩টি কেন্দ্রে সমস্যা জিইয়ে রেখে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এখন নতুন করে ইউনিয়ন পর্যায়ে তিন হাজার কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক প্রসূতিসেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নূর হোসেন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেছেন, ৬০০ চিকিৎসকের পদ শূন্য। তার পরও ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, অধিদপ্তরের বিভিন্ন খাতে যে খরচ তার ৩৩ শতাংশ খরচ হচ্ছে মাতৃ ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্রগুলোর পরিচালনায়। মায়েরা সেবা পান বা না পান কর্মচারীদের বেতন, মহার্ঘ ভাতা, বাড়ি ভাড়া ভাতা, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, টিফিন ভাতাসহ ৩৮টি খাতে সরকারকে টাকা গুনতে হচ্ছে।

বেহাল দশা আজিমপুর মাতৃসদনে
আজিমপুর মাতৃসদনের একাধিক সূত্র বলেছে, ​এখানে সেবা নিতে আসা মায়েদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো বন্ধে গত ১৭ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় চার সদস্যের একটি কমিটি করেছে। ওই কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি এক রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোয় এক চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুপুর আড়াইটার পর এই সদনের রক্তসঞ্চালন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়, আল্ট্রাসনোগ্রাম হয় না, অন্যান্য জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষারও সুযোগ থাকে না। কেন্দ্রের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আড়াইটার পর ইচ্ছে থাকলেও তাঁরা সেবা দিতে পারেন না। শুধু যেসব নারী গর্ভধারণের পর থেকে আজিমপুর মাতৃসদনে সেবা নিচ্ছেন, সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আজিমপুরেই হয়েছে, তাঁদেরই প্রয়োজনের সময় সেবা দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে আজিমপুর মাতৃসদনের তত্ত্বাবধায়ক ইশরাত জাহান বলেন, ১৭৩ শয্যার হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রামের জন্য একজন চিকিৎসক আছেন। তিনি প্রেষণে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুজনকে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া সম্ভব না। চিকিৎসকের সংকটও তীব্র। রাতের বেলা একজন শল্যচিকিৎসক ও একজন অবেদনবিদকে অস্ত্রোপচার, ভর্তি রোগীর সমস্যা, জরুরি বিভাগে আসা রোগী—সবই দেখতে হয়। চিকিৎসা কর্মকর্তাদের (মেডিকেল অফিসার) প্রসূতিসেবায় যুক্ত করা হলে, শিশু বিভাগ অচল হয়ে পড়ে। রাতের পালায় চিকিৎসক বেশি দিলে দিনে কম পড়ে যায়।

গড়ে আজিমপুরে সকাল-বিকাল-রাত এই তিন পালায় কতটি অস্ত্রোপচার হয়েছে, সেই তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সকালের পালায় ১১/১২টি অস্ত্রোপচার, আড়াইটা থেকে সাতটা পর্যন্ত ৪/৫টি আর রাত আটটা থেকে পরদিন সকাল আটটা পর্যন্ত একটি বা দুটি অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে।

আড়াইটার পর এ অচলাবস্থার সুযোগে দালালদের উৎপাত বাড়ে। সম্প্রতি আজিমপুর মাতৃসদনের জরুরি বিভাগের সামনে দুপুর দুইটা থেকে চারটা পর্যন্ত এই প্রতিবেদক দাঁড়িয়েছিলেন। দুইটার পর থেকে জরুরি বিভাগের সামনে প্রথমে একজন ও পরে তাঁর সঙ্গে আরও তিনজনকে যোগ দিতে দেখা যায়। কামরাঙ্গীরচর থেকে আসা এক নারীকে ওই দালাল বাইরের কোনো ক্লিনিকে চলে যেতে পীড়াপীড়ি করছিলেন। এ প্রতিবেদক ব্যক্তিটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি জানান, কাছেই তাঁর একটি ওষুধের দোকান আছে।

ঢাকার বাইরের হাল হকিকত
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ‘সম্প্রসারিত’ সেবা না থাকলেও আজিমপুর মাতৃসদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টার, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নরসিংদী ও ময়মনসিংহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে। তবে গোপালগঞ্জসহ ২৪টি কেন্দ্রের একটিতেও অস্ত্রোপচার হয়নি। নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে স্বাভাবিক ও অস্ত্রোপচার কোনো ধরনের সেবাই পাননি মায়েরা। বরিশাল বিভাগের আটটি কেন্দ্র মিলেও এক মাসে ১০০টি প্রসব হয়নি।

কুষ্টিয়ার মাতৃ ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্রে গত মঙ্গলবার গিয়ে রোগী, চিকিৎসক কাউকেই পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রের একমাত্র চিকিৎসক প্রশিক্ষণ নিতে ঢাকায়, তাই রোগী আসা মাত্রই অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

চিকিৎসক সংকটের কারণে জয়পুরহাটে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে রোগীরা সেবা পান না। চিকিৎসকের দুটি পদই শূন্য। সপ্তাহে দুদিন বগুড়া ও দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে এসে চিকিৎসকেরা সেবা দিয়ে যান।

মুন্সিগঞ্জের মা ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্রে চিকিৎসকের অভাব নেই। কিন্তু দালালের খপ্পরে পড়ে রোগীরা প্রায়ই কেন্দ্রের আশপাশের ক্লিনিকে চলে যান।

বরগুনায় আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু অবেদনবিদ না থাকায় নয় বছর ধরে প্রসূতি সেবা বন্ধ। কেন্দ্রে গিয়ে ৪-৫ জন নারীকে পাওয়া গেছে। তাঁরা এসেছিলেন সর্দি-কাশির চিকিৎসা নিতে।

লক্ষ্মীপুরে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের প্রধান আশফাকুর রহমান বলেছেন, তাঁকে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। তাই সব সময় হাসপাতালে থাকতে পারেন না। তিনি কেন্দ্রের চিকিৎসা কর্মকর্তা, অধিদপ্তরের উপপরিচালক, স্বাধীনতা চিকিৎ​সক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সদস্য, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ‍) লক্ষ্মীপুর জেলার সভাপতি ও থানা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলে জানা গেছে।

সুনামগঞ্জের কেন্দ্রটিতে টিনের ছাউনি, শয্যা সংখ্যা কম। তবু দরিদ্ররা সেবা নিতে আসেন। অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় বেশি রোগীকে সেবা দেওয়া যায় না।

বরিশালে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা আছে। কিন্তু প্রচার নেই। প্রচারের উদ্যোগও নেই।

যা বলছে অধিদপ্তর
অধিদপ্তরের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির কর্মকর্তারা বলেছেন, সারা দেশে ১১২০টি চিকিৎসকের পদ। চিকিৎসক আছেন ৫০৩ জন। ২১টি কেন্দ্রে শল্যচিকিৎসক থাকলে অবেদনবিদ নেই, অবেদনবিদ থাকলে শল্যচিকিৎসক নেই। এক একটি কেন্দ্রে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও একজন অবেদনবিদ আছেন। তাঁদের রোগীর সেবা দেওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনিক সব কাজ করতে হয়। এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকেরা কি করছে, তাও মাঠে গিয়ে দেখতে হয়। চিকিৎসকেরা মাঠে যাবেন, না হাসপাতালে থাকবেন—এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, সংকট জিইয়ে রেখে মাতৃ ও শিশুমঙ্গল কেন্দ্র থেকে এর চেয়ে ভালো ফলাফল আশা করা যাবে না।